২৩/১০/১০

নন্দঘোষ : আবদুশ শাকুর


জন্মাবধি শুনে আসছি-- যতদোষ, নন্দঘোষ। কিন্তু সে হতভাগা-যে আমিই সেটা জানতে পেলাম কেবল পত্নীর মুখে পড়েই। মেয়েটি শুকিয়ে যাচ্ছে কেন? তাজা হাওয়া খাওয়াই না বলে। তার মা মুটিয়ে যাচ্ছে কেন? মোটা ডাক্তার দেখাই না বলে। ছেলেটি হাবা হচ্ছে কেন? তার বাবা পড়ায় না বলে।
অভিযুক্ত আমি পিতার রাজ্যেও হতাম, কিন্তু নিজের গৃহে হই সাব্যস্ত দোষী, অর্থাৎ অ্যালেজ্ড-অ্যাকিউজ্ড নয়, ফাউন্ড-গিল্টি এবং শুনানি-বাদেই। আমার ঘরটিকে ঘিরে অবাঞ্ছিত যা-যা ঘটছে সেসবের জন্যে দোষী অন্য কেউ নয়, সর্বদাই আমি; মানে গৃহস্বামী। এমনকি যা-যা ঘটছে না, সেসবের জন্যে দোষীও একই দাগী আসামী। একটানা নন্দঘোষের ভূমিকায় কোনো রোষেরও উদ্রেক হয় না আর। এমনকি আজকাল তো সামাজিক আসরের অভাবে আমার অশান্তির বাসরে এই দোষী-দোষী খেলা খেলেই এক রকম অন্ধকার আনন্দ আহরণ করতে থাকি আমি। পরিজনের হর্ষ বর্ধন করার দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে আমি তাদের সম্রাট হর্ষবর্ধন। অথচ হর্ষ তো দূরস্থান, এক প্রস্থ ভাঁড়ামিও দীর্ঘক্ষণ খুঁজে না-পেয়ে একদিন আমি ভেবেচিন্তেই একটা নিতান্ত নির্দোষ মন্তব্য করেছিলাম :
‘ভারি বিচ্ছিরি গরম!’
ভাবলাম এ-তো আবহাওয়ার ব্যাপার। এর জন্য নরবিশেষকে দায়ী করা কোনমতেই সম্ভব হবে না। কিন্তু হায়, নারীর রায় তবু চলে গেল আমারি প্রতিকূলে :
‘গরমের দোষ কি? শোবার ঘরের এয়ার-কুলার চুলায় যাক, তুমি বসার ঘরে একটা পেডেস্টালও লাগাতে পারবে না বলে গরম তো তার আপন কাজে আলস্য করতে পারে না তোমার মতো।’
হঠাৎ কালবোশেখীর একটা দমকা এসে ঘরের কোণের কলাগাছটিকে উপড়ে ফেলে দিল। দৃশ্যটি দেখে স্বাভাবিক একটি উক্তিও আমার মুখ থেকে, বলতে গেলে, খসেই পড়ে গেল :
‘এই তো ফের দুর্যোগের দিন এসে পড়ল। এখন কেবল কথায়-কথায় ফোন নষ্ট হবে, কারেন্ট চলে যাবে, পানি থাকবে না-- ভোগান্তির একশেষ হবে আর কি!
ভাবলাম, ঝড়বাদলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর তো মানবিক হাত থাকতে পারে না। সুতরাং দৈব দুর্বিপাকের শিকার ওই কলাগাছটার ব্যাপারে অন্তত এই নরের কোনো অপরাধ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবু নারীর বিচারে আমারি অপরাধ সাব্যস্ত হয়ে গেল :
‘নিজে তো দু-কোদাল মাটি ম্যানেজ করতে পারলে না কলাগাছটির জন্যে। অথচ ইসলামসাহেব? তাঁর পেয়ারা-তলাটা পর্যন্ত বাঁধিয়ে নিয়েছেন এলিফ্যান্ট-ব্র্যান্ড সিমেন্ট দিয়ে। কলাগাছ যার ঘরের ভেতরেই থাকে-- তার ক্ষেতে আর কী করে থাকবে কলাগাছ!’
অতিষ্ঠ হয়ে উঠে গিয়ে কিচেনবাগানটা ঘুরে এসে, অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই একটা সকরুণ খবর দিতে হল এবং সত্যই ভারাক্রান্ত মনে :
‘কাণ্ডটা দেখেছ? তোমার কিচেনগার্ডেনের আলুক্ষেতটাকে যেন ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করে গেছে কোনো আদর্শ চাষী! আহা, কাল বাদে পরশুই তো আলুগুলি তুলে ফেলা যেতো। ফসলটাও ছিল এবার, যাকে বলে, বাম্পার!’
ভাবলাম, এমন মর্মবিদারী অঘটন আর আমার বক্ষবিদারী বয়ান শুনে দিশেহারা গৃহিণী নিশ্চয় ছুটে গিয়ে দেখে আসতে চাইবেন ইঁদুরের তাণ্ডবটা। ইঁদুর দমনের ব্যবস্থায় যেখানে গোটা দুনিয়াই লাচার, সেখানে এই ক্ষুদ্র-মিয়া আমি আর কোন্ ছার। কিন্তু হায় রে বিচার! বিচারপতি পত্নী আমার দ্ব্যর্থহীন রায় দিয়ে দিলেন গৃহপতিরই বিরুদ্ধে :
‘উপড়ে ফেলবেই তো। তোমার সখের শয্যাটিতেও গিয়ে তুরপুন চালাবে। এমন সঙ্গিন গরজেও তুচ্ছ একটা বিড়ালছানা জোগাড় করা তোমার দ্বারা হয়ে উঠল না। আর চৌধুরীসাহেবকে দেখ, কেবলমাত্র সখের বশে আস্ত একটা হরিণশাবক পর্যন্ত কেমন অনায়াসে ম্যানেজ করে ফেললেন।’
এর পরে, তুচ্ছ বিড়ালছানার স্বরে হলেও, ক্ষুদ্র প্রতিবাদ একটা না-করে আর পারলাম না :
‘আচ্ছা, আলুক্ষেতে ইঁদুরের আক্রমণ তো স্বয়ং জাতিসঙ্ঘের বিশেষজ্ঞ-স্বীকৃত একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা। তার ওপর, এ-বছর তো আটলান্টিকের এপার-ওপার আর্জেন্টিনা আর পর্তুগালের তামাম আলুগাছ সাবাড় করে তারা-- ’
‘থামাও তোমার অসার যত কথার ধারা! ওতে শুধু প্রমাণিত হয় যে, তোমার মত অকর্মণ্য লোকে সমগ্র বিশ্বটাই ভরে গেছে আজ। এবং সেজন্যেই তো আজকের ‘গ্লোবাল ভিলেজ’টিও ইঁদুরের মতো তুচ্ছ ভিলেনদেরই ডেন্ হয়ে পড়েছে।’
অনর্থক মন্তব্যরাজি শুনে আমার মুখ থেকে প্রচণ্ড এক গমক হাসি উপচে পড়ল সশব্দ। কিন্তু সকল শব্দ ছাপিয়ে তদ্দণ্ডেই প্রচণ্ডতর একটা মহাশব্দ যেন লাফিয়ে উঠে এল আমার গেটের সামনের রাস্তা থেকে। শব্দটা ছিল দশটনী একটা চলন্ত ট্রাকের টায়ার-ফাটার। আওয়াজটা শোনামাত্র ভাবলাম শেষ বারের মতো কপালটা আরেকবার ঠুকেই দেখা যাক। অতএব এবারে আর পরোক্ষ মন্তব্য নয়, প্রত্যক্ষ প্রশ্নই করলাম একটা :
‘আচ্ছা, ওই টায়ারটা ফাটার জন্যও আমারি কিছু দোষত্রুটি দায়ী নাকি?’
‘শুধু কিছু? সম্পূর্ণ দোষটাই তো তোমার। তুমি একটা ফাটা-কপাল বলেই তো, তোমার বাসাটা ক্রস করতেই বেচারার ওই দশ-টনী ট্রাকের টায়ারটাও ফস করে ফেটে গেল। এবং এজন্যেই তো এ-ধরনের অপয়াদের কমপক্ষে¬’
‘ডিভোর্স?’
সটান দাঁড়িয়ে দুহাত বাঁকিয়ে কোমরে ঠেকিয়ে মুখোমুখি হয়ে মুখরা রমণী ব্যাখ্যা দাবি করলেন :
‘ডিভোর্স-শব্দটার সঘন চর্চা হয় মনে হচ্ছে?’
‘তা হবে কেন, তোমার কথার স্রোতের টানে-- ’
‘আমি তো বলছিলাম ‘কমপক্ষে’ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দানের কথা।’
‘আচ্ছা! যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত দোষী এখনো তবে নই আমি।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন