৩/১১/১০

`করতে হবে’


আমার দূরসম্পর্কের কাজিন আলমভাই পঁচিশ বছর আগে আইএ পাশ করে অনেককিছুই গভীরভাবে ভেবেছেন অনেককাল এবং অস্থিরভাবে করেছেন কিছুকালকিন্তু উদ্যোগের অভাব আর আলস্যের প্রভাবে--হয়নি কিছুই বরং গিয়েছে সবইআছে কেবল পিতৃদত্ত নাম আর পত্নীদত্ত বদনামতবে তাঁর সব ব্যর্থতার লাগসই জবাব আছেযেমন মাস্টারি করতে পারলেন না, কারণ মাস্টারে আর ডাস্টারে তফাৎ নেইতেমনি ঠিকাদারি হল না, কারণ ঠিকাদারি মানেই চুরিচামারিদোকানদারি হল না, কারণ ওটা বাকিবকেয়ার ঝকমারিব্রোকারি হল না, কারণ ওটা দালালি; যা খোলাখুলি একটি গালি
তবে আলমভাইকে যত নিষ্কর্মা মনে হয়, আসলে তত নিষ্কর্মা তিনি ননকরিতকর্মা না হলেও, ‘করিবকর্মাতাঁকে বলতেই হবেকেননা কর্মটা তিনি বরাবরই করেন--তবে বর্তমানকালে নয়, ভবিষ্যৎকালেবর্তমানে কেবল ভবিষ্যতকর্মের ছক কাটেন, আর অতীতকর্মের ত্রুটি ঘাঁটেনফলে, তখন অমন করলে এখন এমন হত আর এখন এমন করলে তখন অমন হবে--এবংবিধ বচনই শুধু শ্রুত হয় তাঁর শ্রীমুখ থেকেএককথায়, কর্তব্য সম্পর্কে সদা-সচেতন এবং সম্পাদন সম্বন্ধে আপাত-অচেতন আলমভাই আমাদের বহু বিশেষণেই বিশ্রুত ছিলেন--অতীতের নাগরিক, বর্তমানের দার্শনিক, ভবিষ্যতের স্বাপ্নিক ইত্যাদিএবারে অনেক বছর পরে এলেন বলে জানতে চাইলাম :
শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামলেন আলমভাই?’
জীবনে অনেক কিছুই তো করতে চাইলাম হেশেষ পর্যন্ত ভাবলাম চাকরিটাই আমার জন্যে ঠিক
একেই বলে মানুষের মন! এত গবেষণাশেষে কর্মজীবনটি শুরু করলেন--তাও সেই চাকরি দিয়ে? মানে আপনার কৃপার বস্তুটি দিয়ে? তা চাকরিতে মন বসল কত দিন হল?’
তিন বছর
চাকরিটি কী?’
ভাবতে হবে
কাজটা কোথায়?’
দেখতে হবে
চিরপরিচিত সেই অসমাপিকা ক্রিয়াপদটি দুই-দুইবার শুনতে পেয়ে সভয়ে জানতে চাইলাম :
কিছু মনে করবেন না আলমভাই, চাকরিতে আপনি যোগ দিয়েছেন তো?’
আর কীইবা করার আছে এ-দেশে বল? চাকরিতেই তো যোগ--দিতে হবে
দিতে হবে! তার মানে খোঁজ পেয়েই ছুটে এসেছেন যোগ দিতে?’
চাকরির খোঁজ কি কেউ কাউকে দেয় ভাই! খোঁজখবরও নিজেকেই--নিতে হবে
নিতে হবে! তা ঘরের কাছের চাটগাঁয়ও কোন কিছুর খোঁজ পেলেন না? ক্ষমতাসীন দলের একজন নির্মোহ কর্মী হয়েও সামান্য একটা চাকরির খোঁজে আপনাকে ঢাকা পর্যন্ত ছুটে আসতে হল?’
ছুটে আসা ছাড়া উপায় কি বল? ছোটাছুটি ছাড়া কোন্ কাজটাইবা সম্ভবএখানে ছুটে এলাম, না হলে চট্টগ্রামে ছুটবএবং সেখানেও না-হলে তো খুলনা-পাবনাও--ছুটতে হবে
ছুটতে হবে! এবং ছোটাছুটিরও এখান থেকেই শুরুঅযথা ছোটার আগে, ছুটে গিয়ে যে-শক্তিধরদের ধরতে হবে তাঁদের ধরার ব্যবস্থা করেছেন?’
আলমভাই যেন এই প্রথম একটু আহত হয়েই কথা বললেন :
, মামা ধরার কথাটাও শিখিয়ে দিচ্ছ? আরে ভাই, সর্বপ্রথমে তো মামাই--ধরতে হবে
ধরতে হবে! মামার টাকার জোগাড়--’
টাকার জোগাড়েও-- নামতে হবে
নামতে হবে! তবে কেনা-মামা নাকি অধিক দাম পেলেই বেহাত হয়ে যায়অথচ সঠিক চিনে নিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদস্থ লোকের পদ জড়িয়ে ধরতে পারলেই নাকি পদবি-পদক থেকে পদস্থ চাকরি পর্যন্ত সবই সুনিশ্চিত হয়ে যায়কিন্তু আলমভাই, আপনি কি অতটা পারবেন?’
উপায় কিঅপরিহার্য হলে পায়ের ওপরও--পড়তে হবে
পড়তে হবে! কিন্তু আপনি একটা পা ধরতেই আরেকজন যদি আরেকটা পা ধরে ফেলে, তবে তো ড্র হয়ে যাবারই আশঙ্কাদুখানি চরণই যদি আপনি  দুহাতে জাবড়ে ধরে ফেলতে পারেন, তবে আর কোনো রিস্ক্ই থাকে নাকিন্তু ভাই, এতখানি আপনার পক্ষে কি সত্যি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না?’
নাতুমি তো জানো ভাই, পঁচিশটি বছর ধরে কেবল করণীয়-কর্মের কর্ষণ করতে করতে আমি এক ধরনের অসাধারণ কর্মী হয়ে উঠেছিঅতএব কর্তব্য-কর্মে গাফলতি, সে আমার নয়চাকরির জন্যে দরকার হলে আমাকে দুপায়ে মাথা খুঁড়েই--মরতে হবে
মরতে হবে! একেই বলে কর্তব্যে নিষ্ঠাএবার দেখছি আমাদের করিবকর্মাআলমভাই একেবারে মরণপণ কর্তব্যপরায়ণঅতএব সেই ভাবতে হবেথেকে দেখতে হবে, দিতে হবে, নিতে হবে, ছুটতে হবে, ধরতে হবে, নামতে হবে, পড়তে হবে, মায় মরতে হবেপর্যন্ত--তাঁর সঙ্গেকার এই সারগর্ভ সংলাপের সার-সংক্ষেপটাই শুধু অনুমোদন করিয়ে নেবার আশায় নিবেদন করলাম :
তাহলে আলমভাই, আপনার চাকরির সব কিছুই এখনো সেই চিরশ্রুহবের স্তরেই রয়েছেতিন বছরআগে হয়েছে শুধু চাকরি করার সিদ্ধান্তটাই
উপায় কি ভাই! কর্তব্যকার্য বা করণীয়কর্ম ছাড়া কাজের মানুষ কি বাঁচতে পারে? তাই একটা কিছু তো আমাকে--করতে হবে
করতে হবে! এ-আপনার নিতান্তই বিনয় আলমভাইশুধু আপনাকে কেন এবং কেবল একটা-কিছু কেন, কবির প্রত্যয় এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমিযদি সত্যই হয়--তবে বাংলাদেশ তো ভবেরই ভবিষ্যৎঅতএব আমাদের ক্রিয়ামাত্রই তো ভবিষ্যৎকালেই--করতে হবে
তাঁর এবং আমার দ্বৈতকণ্ঠের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণে আলমভাইয়ের বিধেয়টা বাঙলার সকলভাইয়ের বাকি সব শ্লোগানের মতোই শোনাল--মানে, শূন্যগর্ভ বলেই উচ্চকণ্ঠ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন